স্বদেশ ডেস্ক:
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ার আঁচ এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে আমদানিনির্ভর বাংলাদেশ। আঁচের তীব্রতা যেন না বাড়ে, সে জন্য একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে ‘স্পট মার্কেট’ থেকে বেশি দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনতে হচ্ছে সরকারকে। দেশের বাজারে যেন দাম না বাড়ে, সে জন্য ভর্তুকি বাড়ানোর চিন্তাভাবনাও চলছে। আবার সরকারকে দাম বাড়ানোর প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
এলএনজির দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বাড়িয়েছে সরকার। তবে জ্বালানি তেলের বাজারেও চলছে অস্থিরতা। একই অবস্থা কয়লার বাজারেও।
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম এখন ৮১ ডলার। গত ১২ অক্টোবর ছিল ৯৪ ডলার। ১০০ ডলারে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। এর আগে ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর তেলের দাম ৮০ ডলারের ওপরে উঠেছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ আরো সংকটে পড়বে।
সংকট কাটাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে তেল-গ্যাসের দাম বাড়াতে পারে জ্বালানি বিভাগ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) দাম বাড়ানোর জন্য জ্বালানি বিভাগে চিঠিও দিয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববাজারে এক ধরনের সংকট চলছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। কারণ বাংলাদেশের জ¦ালানিব্যবস্থা আমদানিনির্ভর।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জ্বালানির দাম পর্যবেক্ষণ করছি। যতক্ষণ পারা যায়, দাম না বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে। তবে দীর্ঘসময় আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম
বাড়তি থাকলে অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম বাড়াতে বা সমন্বয় করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম অব্যাহত থাকায় জ্বালানিখাতে সরকার ভর্তুকির পরিমাণও বাড়বে। এরই মধ্যে জ্বালানি বিভাগ থেকে অর্থমন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
করোনা মহামারির কারণে গত বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানির চাহিদা অনেক কমে যায়। কমে যায় দামও। তবে চলতি বছর দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অন্যদিকে দাম বাড়লেও সরবরাহব্যবস্থা আগের মতো বাড়েনি। গত জানুয়ারিতে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৪৯ ডলার। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ ডলারে।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, এখন ‘স্পট মার্কেট’ থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ (ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজি ৩২ থেকে ৩৬ ডলারে কিনতে হচ্ছে। অথচ কয়েক মাস আগে সেটা ৬ ডলারের মধ্যে ছিল। বেশি দামের কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনতে নিষেধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু হঠাৎ করে গ্যাসের সংকট বেড়ে যাওয়ায় আবার সেটার অনুমতি দিয়েছেন। এখন বাড়তি দামে তিনটি এলএনজির কার্গো আমদানি করছে পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলা বলছে, বাড়তি দামের ফলে এই তিন কার্গোতে অতিরিক্ত দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা বেশি গুণতে হবে সরকারকে। আর্ন্তজাতিক বাজারে লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বা বোতলজাত গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশেরে বাজারে সিলিন্ডার গ্যাসের দামও বাড়িয়েছে সরকার।
আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দামও বেড়েছে। গত সোমবার গ্যাসোলিনের গড় মূল্য ছিল গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুধু গত সপ্তাহে আর্ন্তজাতিক বাজারে গ্যাসোলিনের দাম সাত সেন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি গ্যালন ৩ দশমিক ২৭ ডলারে। গত বছরের এপ্রিলে প্রতি গ্যালনের দাম ছিল ১ দশমিক ৭৭ ডলার। জ¦ালানি ব্যবসায় সর্ম্পৃক্ত আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, শীতে জ্বালানির দাম হবে আকাশচুম্বী। প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে শীতে চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্ভরশীলতা বাড়বে। এর প্রভাবে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ১০০ ডলারও হতে পারে। এদিকে বন্যায় ভারত ও চীনে কিছু কয়লা খনিতে সংকট দেখা দেয়। ফলে কয়লার দামও অনেক বেড়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বিপিসির প্রতিদিন গড়ে লোকসান হচ্ছে ২১ কোটি টাকা। বিপিসির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ৭০ ডলারের মধ্যে কিনতে পারলে বিপিসি লাভে থাকে। কিন্তু ৭০ ডলারের বেশি হলেই লোকসান গুণতে হয়। এখন প্রতি লিটার ডিজেলে ১৩ টাকা ৬০ পয়সা ও ফার্নেস অয়েলে ৮ টাকা ৫০ পয়সার মতো লোকসান গুণতে হচ্ছে।
বিপিসির তথ্যমতে, দেশে বছরে ৫৫ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। প্রতিদিন গড়ে ডিজেল বিক্রি হয় ১২ হাজার ৮০০ টন। ফার্নেস অয়েল বিক্রি হয় দুই হাজার টন।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব বিদ্যুৎ উৎপাদনে পড়বে কিনা- এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘অবশ্যই প্রভাব পড়বে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকি দেয়। তেলের দাম বাড়তে থাকলে পিডিবির লোকসানও বাড়বে। সরকারকে বেশি করে ভর্তুকি দিতে হবে।’ বিদ্যুতের দাম বাড়বে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে দাম না বাড়ালে ভর্তুকি বাড়াতে হবে।’
বিশে^র আরো অনেক দেশ জ্বালানির সংকটে পড়েছে। বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছে চীনের মানুষ। ভারতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কয়লার মজুদ কমে গেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ায় ইউরোপের ক্রেতারা বেশি দামে জ্বালানি কিনছে।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ মেহেদী হাসান আমাদের সময়কে বলেন, ‘এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা পুরোপুরি বিপিসিকে দেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘জ¦ালানি তেলের দাম সমন্বয় করার ক্ষমতা বিপিসিকে দিলে, মাসে মাসে আর্ন্তজাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে সেটা সমন্বয় করা যাবে। বিপিসি এ ক্ষেত্রে লাভের চেষ্টা করবে না।’
ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম কম। ফলে ভারতে তেল পাচারের আশঙ্কা করছে বিপিসি। বিপিসির কর্মকর্তারা বলছে, সীমান্তবর্তী জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে তেল পাচাররোধে সর্তক থাকতে বলা হয়েছে।
পাচারের উদাহরণ দিতে গিয়ে বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পণ্যবাহী অনেক ট্রাক ট্যাঙ্কে কম তেল নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। এরপর বাংলাদেশ থেকে ট্যাঙ্ক ভর্তি করে তেল নিয়ে চলে যায়।’